বাংলাদেশের কোনো গ্রাম কিংবা মফস্বল শহরের এক তরুণের কথা ভাবুন। যে তরুণ সদ্যই উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো পা রেখেছে রাজধানী ঢাকায়। রাস্তাঘাট, মানুষজন—সবই তার কাছে অচেনা। কখনো সে লালবাগ কেল্লা দেখতে গিয়ে পুরান ঢাকার রাস্তা হারিয়ে গুবলেট পাকিয়ে বসে থাকে। আবার কখনো মোহাম্মদপুরে খাসির চাপ খেতে গিয়ে ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়ে নিজেই চাপে পড়ে যায়। মোটকথা, ‘গ্রাম’ থেকে ঢাকায় নতুন আসা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই এসব অভিজ্ঞতা অচেনা নয়। এবার লিওনেল মেসিকে এমন একজন হিসেবে কল্পনা করুন। ক্লাব বদল করে তিনিও এখন ফ্রান্সের প্যারিস শহরের নতুন বাসিন্দা। প্যারিসের রাস্তাঘাট, মানুষ কিংবা খাবারদাবার—ধরা যাক সবই মেসির অচেনা। এটা ধরে নিলে বার্সেলোনা থেকে প্যারিস শহরে এসে মেসি কোন কোন সমস্যায় পড়তে পারেন? আসুন, দেখা যাক…
প্রথম সমস্যা
প্যারিসে আসার পর মেসি প্রথমেই বাসা ভাড়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। এ শহরে ব্যাচেলরদের কেউ বাসা ভাড়া দেবে না জেনে পরিবার নিয়েই প্যারিসে এসেছেন তিনি। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। বাসা ভাড়ার বিজ্ঞপ্তিতে লেখা থাকে, ‘বাসা ভাড়া দেওয়া হবে (চাকরিজীবী ছোট পরিবার)’। তিন সন্তান নিয়ে মেসি ও তাঁর স্ত্রীর মাঝারি আকারের পরিবার। পরিবারের পাঁচ সদস্যের ব্যাপারটা নিয়ে কোনোভাবে বাড়িওয়ালাকে পটাতে পারলেও মেসির ফুটবলার পেশাটিকে কোনোভাবেই ‘চাকরি’ হিসেবে মেনে নিতে চান না বাড়িওয়ালারা। তার সাফ কথা, ‘বছরে যত বেতনই পান না কেন, আপনি কি বিসিএস ক্যাডার? সরকারি চাকরি করেন? করেন না। সরকারি চাকরি করলে বাসা ভাড়া দিতাম। এখন আসতে পারেন।’
দ্বিতীয় সমস্যা
বাসা ভাড়া না পেয়ে অবশেষে হোটেলেই দিন কাটাচ্ছেন মেসি। তবে হোটেলে সমস্যা হলো, সেখানে সপ্তাহে মাত্র এক দিন পানি থাকে। ফরাসিদের গোসল নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। এ জন্যই তো তারা পারফিউম বা সুগন্ধি উৎপাদনে বিশ্বসেরা। কিন্তু মেসির পরিবারের সদস্যারা তো সপ্তাহে এক দিন গোসল করে অভ্যস্ত নয়। এ নিয়ে মেসির সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আন্তোনেয়া রোকুজ্জোর প্রায় দিনই মনোমালিন্য হচ্ছে বলে গোপন এবং অবিশ্বস্ত এক সূত্রে জানা গেছে। এমনকি সম্প্রতি ফরাসি এক গণমাধ্যম মেসি ও তাঁর স্ত্রীর ফোনালাপের অডিও ফাঁস করেছে। এতে মেসির স্ত্রীকে বলতে শোনা গেছে, ‘তোমাকে বিয়ে করে আমি কী পেয়েছি? এর চেয়ে তো আমাকে মিরপুরে রাখলে ভালো করতে। সেখানে সাত দিন না হোক, চার-পাঁচ দিন তো পানি পেতাম!’ এমন অবস্থায় মেসি তাঁর প্রতিবেশী দেশের ছোট ভাই নেইমারের বাসায় সাবলেট থাকার পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।
তৃতীয় সমস্যা
বার্সেলোনা ছেড়ে এসে মেসির মন খারাপ, সেটা সবারই জানা। তাই মন ভালো করতে প্যারিসের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখতে পরিবার নিয়ে বেরিয়েছেন। ল্যুভর মিউজিয়াম আর আইফেল টাওয়ার দেখবেন। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার পর অবশেষে এক অটোরিকশাচালক মিটারে যেতে রাজি হলেন। কিন্তু সেই চালকের চালাকি বুদ্ধির ড্রিবলিংয়ের কাছে পরাজিত হলেন মেসি। সোজা রাস্তায় যানজট আছে বলে অনেক অলিগলি ঘুরিয়ে অটোরিকশা যখন ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনে থামল, মেসি তখন মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ভাড়া স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। টাকা নেওয়ার সময় অটোরিকশাচালক একটা মুচকি হাসি দিয়ে বোঝালেন, মেসি নিজের জালে নিজেই গোল দিয়েছেন। চালকের কাছে বোকা বনে যাওয়ায় মনে একটা খচখচানি নিয়েই ঘোরাঘুরি করলেন মেসি।
চতুর্থ সমস্যা
অটোরিকশায় দ্বিগুণ ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারটা মেসি পরদিনও ভুললেন না। তাই মাঠে প্র্যাকটিসে যাওয়ার সময় খরচ বাঁচাতে লোকাল বাসে ঝুলে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে তেড়েফুঁড়ে ঢুকতে মেসির যখন সমস্যা হয় না, তখন লোকাল বাসে ঠেলাঠেলি করে ওঠা তো নস্যি। বাসে কোনোরকমে উঠে মেসির মনে পড়ে গেল সুনির্মল বসুর পরিচিত পঙ্ক্তি, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র…’। মেসি ভাবলেন, তিনি তো পিএসজির কোচ মরিসিও পচেত্তিনোর ছাত্র। তিনি তো খেলা শিখতেই যাচ্ছেন। তাহলে তো বাসে স্টুডেন্ট ভাড়া দিলেই চলবে। অতএব কন্ডাক্টর তাঁর কাছে ভাড়া চাইতেই পকেট থেকে বের করে দিলেন ‘হাফ ভাড়া’। লকডাউনের কারণে অনেক দিন বাস বন্ধ থাকার পর ‘হাফ ভাড়া’ দেখে কন্ডাক্টর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ৩৪ বছর বয়সে মেসি কোন ক্লাসের ছাত্র জানতে চাওয়ার পাশাপাশি দু-চারটা কটু কথা শোনাতেও ভুললেন না কন্ডাক্টর। একপর্যায়ে শুরু হলো কথা–কাটাকাটি। অমনি বাসে বেধে গেল তুমুল গ্যাঞ্জাম। বাসে থাকা বাকি ছাত্ররাও মেসির পক্ষ নিল। ঝগড়া এমন পর্যায়ে চলে গেল যে বাস ভাঙচুর শুরু করে দিল বাসের ছাত্ররা। মেসি উত্তেজিত ছাত্রদের থামাতে গিয়ে দেখলেন, বাসটা পিএসজির মাঠের সামনে চলে এসেছে। অগত্যা বাস থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলেন। তবে ভুল করে ডান পা দিয়ে নামতে গিয়েই খেলেন একটা হোঁচট। দ্বিতীয় হোঁচটটা খেলেন পকেটে হাত ঢোকানোর পরপরই। কারণ, তাঁর পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি ততক্ষণে উধাও। যে মেসির পা থেকে কেউ সহজে বল কাটিয়ে নিতে পারে না, সেই মেসির মোবাইল ফোনটাই পকেট কেটে নিয়ে গেছে কোনো এক ঝানু খেলোয়াড়।
পঞ্চম সমস্যা
প্র্যাকটিস শেষে মেসিকে সবাই মোবাইল ফোন হারানোর জন্য সান্ত্বনা দিল। এর মধ্যেই মেসিকে নেইমার প্রস্তাব দিলেন, ‘চলেন ভাই, সামনের টংয়ে গিয়ে চিল করি।’ মেসি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। টংয়ের চা খাওয়ার আগে মেসি এক ইউরো দিয়ে এক গ্লাস ফিল্টারের পানি পান করেছিলেন। সেই ফিল্টারের পানিই মেসির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। পরদিন ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হলেন হাসপাতালে। খবর পেয়ে ওরস্যালাইন নিয়ে মেসিকে দেখতে গেলেন নেইমার আর এমবাপ্পে। নেইমার সান্ত্বনাসূচক হাসি দিয়ে বললেন, ‘ভাই, নতুন শহরে আসার পর সবাই কমবেশি ধরা খায়। বার্সেলোনা থেকে প্যারিসে এসে আমিও প্রথমে ধরা খেয়েছি। ধরা খেয়েই সবাই শেখে।’ পাশ থেকে এমবাপ্পে তখন বলে উঠলেন, ‘ভাই, ওই যে একটা লাইন আছে না—“বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র…”। ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই।’ এ কথা শুনে বাসে হারানো মোবাইল ফোনের কথা ভেবে মেসির বুকের বাঁ পাশের কোথায় যেন হু হু করে উঠল। আহা বার্সেলোনা! আহা চেনা পথঘাট, পরিচিত বাতাস…!