বিরাট কোহলির শেষের শুরু? না সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বোর্ডপ্রধান হিসাবে অপদস্থ হওয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি? ভারতবর্ষীয় ক্রিকেটের মহাবিতর্কিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে এগোচ্ছে, বৃহস্পতিবার দিনভর সেই জল্পনা আর চাঞ্চল্য ব্যাহত থাকল। বেহালার বীরেন রায় রোড এমনিতে সরু রাস্তা।
সেখানে কার্যত গোটা দিন জুড়ে যে পরিমাণ ক্যামেরা আর ভিড় দেখা গেল তাতে মনে হতে পারে পুরনির্বাচনের প্রচারে বুঝি একাধিক প্রভাবশালী মুখ বেরিয়েছে। আসলে ওই ভিড় মিডিয়ার। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্রিকেটার জীবনে যেমন ক্যামেরা আর ওবি ভ্যান এইগুলি প্রত্যক্ষ করত, বোর্ডের মুখ্য প্রশাসকের জন্য তেমনই জমায়েত হয়েছিল। সমবেত প্রশ্ন বিরাটের আনা অভিযোগের জবাবে বোর্ড কী করবে? কী বলবে?
সৌরভ বহুদিনই প্রশাসনিক কাজকর্ম সারেন বাড়ি থেকে ছয়-সাতটা বাড়ি দূরে নিজের অফিস উইলো টাওয়ারে। এদিন বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে দেখেন কিছু উৎসাহী অফিসের গেটের ভেতরে অবধি ঢুকে যাচ্ছে। খানিকটা বিরক্ত হয়েই তিনি ভেতরে ঢুকে যান। বলে যান, উপযুক্ত ব্যবস্থা বোর্ড যথাসময়ে নেবে।
বিকেলে সংবাদ প্রতিদিনকে একই কথা ছয়তলার নিজের চেম্বারে বসে বললেন। ততক্ষণে বিরাটরা দলবল-সহ সাউথ আফ্রিকায় নেমে গিয়েছেন। অতীতে ভারতীয় ক্রিকেটারেরা সাধারণ কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে ট্রাভেল করতেন। কিন্তু কোভিডের জন্য এখন বোর্ড অনেক বেশি টাকা খরচ করে তাদের চার্টার্ড ফ্লাইটে নিয়ে যাচ্ছে।
বিদেশি শহরে নেমেও থাকছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এবার যেমন হোটেলে না তুলে কোহলিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেঞ্চুরিয়ান মাঠের কাছে অসামান্য এক রিসর্টে। সাউথ আফ্রিকা বোর্ড স্বাগত জানিয়েছেও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে।
কিন্তু আগামী ক’দিনে এই আন্তরিকতা কি ভারত অধিনায়ক তাঁর বোর্ডের কাছে পাবেন? সৌরভকে দেখে মনে হচ্ছে গত চব্বিশ ঘণ্টায় তাঁর ওপর দিয়ে একটা ঝোড়ো সামুদ্রিক হাওয়া বয়ে গিয়েছে। এই সৌরভ অবসরের তেরো বছর পরেও ৩৩টা ব্র্যান্ডের মডেল, দাদাগিরির মহাসফল সঞ্চালক, দুরন্ত পাবলিক স্পিকার, রসবোধসম্পন্ন মানুষ নন।
ইনি দৃশ্যতই ক্রুদ্ধ। না জিজ্ঞেস করেও বোঝা সম্ভব যে গভীর অপমানিত এবং অসম্মানিত বোধ করছেন। যাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গোটা ক্রিকেটবিশ্বে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন কোহলি। ভাবমূর্তিতে সামান্য কালো ছোপ পড়া সৌরভ আপাতত এ নিয়ে মুখ খুলবেন না। তাঁর কাছে এটা ব্যক্তি সৌরভের ইস্যু নয় যে তিনি মিডিয়ার সামনে একা দাঁড়িয়ে পড়বেন। এটা ভারতীয় বোর্ড প্রধানের ইস্যু। তাই জবাব যদি দিতেই হয় একমাত্র মাধ্যম ভারতীয় বোর্ড।
দিল্লি ও মুম্বইয়ে ফোন করে জানা গেল, বোর্ড সচিব জয় শাহ এবং তাঁর টিম নাকি খুব ক্ষুব্ধ। অনেকের আশ্চর্য লাগছে যে ভিভিও কনফারেন্সে এতগুলো মানুষের উপস্থিতি থাকার পরেও কী করে কোহলি এত বড় কথা অম্লানবদনে বলে দিলেন সৌরভকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে? কারও কারও আবার মনে হচ্ছে গোটা ঘটনাটা ভুল বোঝাবুঝিতে।
বোর্ড কোহলিকে বলেছিল, এখনই বিশ্বকাপের আগে টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেন্সি না ছাড়তে। একটু ভাবতে। কারণ টুর্নামেন্টের আগে ছাড়লে টিমের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। সেটাই হয়তো সৌরভ বলতে চেয়েছেন যে আমরা তো ওকে তাড়াহুড়ো না করতে বলেছিলাম। ধৈর্য ধরতে বলেছিলাম। সেটাই তো বকলমে নেতৃত্ব না ছাড়তে বলা। আবার কোহলি হয়তো ভাবছেন, আমাকে ভাবতে বলেছিল ঠিক। কিন্তু এইভাবে তো বলেনি যে কিছুতেই তোমার যাওয়া চলবে না।
কোনও আন্তরিকতা তো দেখায়নি। যাবতীয় সংশয়, ভুল বোঝাবুঝি আর পারস্পরিক দোষারোপ কি এই জায়গাটায় এসে? তবে একটা ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে সেই বিনোদ রাইয়ের সময় থেকে বোর্ডের একরকম জামাই আদরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন কোহলি। এতটুকু বেচাল হলেই তিনি উতলা হয়ে পড়েন।
তাঁর আচরণ নিয়ে বোর্ডের অন্দরমহলে পর্যাপ্ত উত্তেজনা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচকদের কোহলি নাকি একেবারে পাত্তা দেন না। মুখ্য নির্বাচক চেতন শর্মা (Chetan Sharma) নাকি তাঁকে তিনবার ইংল্যান্ড সিরিজের সময় ফোন করেছিলেন। তিনবারই বিরাট বলেন, এখন একটু ব্যস্ত। কল ব্যাক করছি। কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।
বোর্ডের মধ্যে হালকা মতভেদ আছে কীভাবে বিরাট-বিতর্ক সামলানো যায় তা নিয়ে। সচিবের মনে হচ্ছে কড়া করে হলেও মৌখিক ব্যাখ্যা চাই। কারণ সরকারিভাবে মেইল গেলে টিম বিদেশে সিরিজ খেলার সময় একটা কেচ্ছা-বিতর্ক তৈরি হবে। আবার সৌরভ শোনা যাচ্ছে চরমপন্থী। তিনি চান এসপার নয় ওসপার। সেটা একমাত্র সম্ভব অধিনায়ককে অফিসিয়ালি কারণ দর্শাতে বললে।
এব্যাপারে কিন্তু কোনও বিতর্ক নেই যে মহাবিতর্কিত ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের দিকে প্রভাব টেনে আনার ব্যাপারে বিরাট ছয় গোল দিয়েছেন। সে তিনি দোষী অভিযুক্ত হোন বা না হোন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রচারব্যবস্থা যে কত ভঙ্গুর ছিল তা এই ঘটনায় পরিষ্কার। দেখে কারও কারও মনে হচ্ছে সৌরভের বোর্ডের এত জাঁকজমক ।
আর ঐশ্বর্য থাকতে পারে যে বিগ ব্যাশের মতো হাই প্রোফাইল টি-টোয়েন্টি লিগের শতকরা ৫১ শতাংশ দখল কিনে নেওয়ার তারা তোড়জোড় করতে পারে। ছাদ ভেঙে উপরে উঠে যেতে পারে তাদের নতুন আইপিএল (IPL) চুক্তির স্পনসরশিপ অঙ্ক। কিন্তু তাদের না আছে বিজেপি আইটি সেলের মতো কোনও অমিত মালব্য। না আছে কোনও পিকে, যিনি টিমে থাকলে হয়তো আজকের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা হয় না।